Search

Banner ad

Friday, June 2, 2017


কালের পুরাণ

ভাস্কর্য নিয়ে মতৈক্য হলে নির্বাচন নিয়ে কেন নয়?


বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। এখানে গতকালের ফকির যেমন আজ আমির হয়ে যান, তেমনি গতকালের শত্রুরও মিত্র হতে বাধে না। আশির দশকে যখন এরশাদের পুলিশ বাহিনী আওয়ামী লীগের নেতাদের চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালিয়েছিল কিংবা মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের হত্যা করেছিল, তখন কেউ কি ভাবতে পেরেছেন, সেই এরশাদ একদিন আওয়ামী লীগের পরম মিত্র হবেন? এখানে স্বৈরাচারীরা ভোল পাল্টে কিংবা লেবাস বদল করে অনায়াসে গণতান্ত্রিক হয়ে যান। কিন্তু গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা প্রকৃত ‘গণতন্ত্রী’ হতে পারেন না।
কে বলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য নেই? শতভাগ মতৈক্য আছে। ৯/১১-এ যখন সন্ত্রাসীরা আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে, তখন  মার্কিন প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয় বুশ তাঁর কুখ্যাত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বাংলাদেশের সমর্থন চান। তিন মাসের অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাধ্য ছিল না এই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তাদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোভাব জানতে চাওয়া হয় এবং তাদের কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেয়েই বাংলাদেশ কথিত ওয়ার অ্যাগেইনস্ট টেররে সমর্থন দেয়। তারপর কত সরকার এল গেল। কিন্তু সেই সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে, এ রকম খবর আমাদের জানা নেই।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্য সরানোর বিষয়েও আমরা জাতীয় মতৈক্য দেখেছি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ক্ষমতার অংশীদার জাতীয় পার্টি ও  বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে। তিন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা হেফাজতে ইসলাম নামের মৌলবাদী সংগঠনটির দাবি অকপটে মেনে নেন এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ফটকের সামনে থেকে ভাস্কর্যটি সরানোয় সন্তোষ প্রকাশ করেন।
 কাজটি ভালো হয়েছে না মন্দ হয়েছে, আমরা সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। এখানে বিবেচ্য হলো দেশের তিনটি প্রধান দল একটি বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেছে যে ন্যায়বিচারের প্রতীক গ্রিক দেবীর বাঙালি শাড়ি পরানো ভাস্কর্যটি ওখানে থাকা ঠিক নয়। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ তাদের বাম মিত্র ও উদার বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতার ঝুঁকিও নিয়েছে। অর্থাৎ এই প্রশ্নে তারা বাম মিত্র কিংবা উদার বুদ্ধিজীবীদের চেয়েও হেফাজতের কাছাকাছি। আর বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টিকে এ রকম কোনো বিরোধিতায় পড়তে হয়নি। তাদের ভাবা হয় হেফাজতের সহজাত মিত্র। ২০১৩ সালে ঢাকা শহরে হেফাজত যখন তাণ্ডব চালিয়েছিল তখন কেবল বিএনপিই তার পক্ষে অবস্থান নেয়নি, বিজয়নগরে গাছ কাটার মহড়ায় জাতীয় পার্টির কর্মীরাও অংশ নিয়েছিলেন।
এখন ভাস্কর্য পুনঃস্থাপন নয়, সরানোর কৃতিত্ব নিয়ে বিতর্ক চলছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভাস্কর্য সরানোর সিদ্ধান্ত সরকার নেয়নি, নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেছেন, এতে সরকারের কোনো কৃতিত্ব নেই। মাননীয় প্রধান বিচারপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জাতীয় পার্টির নেতা জি এম কাদের ভাস্কর্য সরানোকে ভালো কাজ বলে সাফাই গেয়েছেন। সব দলের লক্ষ্য হেফাজতের ভোট।
তাহলে একটি ভাস্কর্য, সেটি ভালো হোক বা মন্দ হোক, নান্দনিক হোক বা কদর্য হোক (শিল্পী নিসার হোসেন প্রথম আলোতে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, ঢাকা শহরের অধিকাংশ ভাস্কর্য এতই কদাকার যে তাকানো যায় না।) সেটি সরানোর ব্যাপারে যদি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে মতৈক্য হতে পারে, তাহলে নির্বাচনের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা একমত হতে পারছে না কেন? কেন তারা পররাষ্ট্রনীতি বা জঙ্গিবাদের বিপদ নিয়ে কথা বলবে না? গণতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান শর্তই হলো আলোচনা। জনগণ ভোট দিয়ে যে সংসদ বানায়, সেখানে যদি সরকারি ও বিরোধী দল বসে কথাই বলতে না চায়, তাহলে নির্বাচনেরই-বা কী দরকার?
গত সপ্তাহের কালের পুরাণে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটি তোলায় অনেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। একজন লিখেছেন, ‘অসাধারণ যুগোপযোগী একটি লেখা। আর এটা তো নতুন কিছু নয়। রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, সহনশীলতা এবং “সবার আগে ভারত” এই নীতিতে ভারতের নেতা-কর্মী অনেক আগে থেকেই আমাদের থেকে অনেক পরিণত এবং একতাবদ্ধ। তৃণমূল থেকে শুরু করে বিধানসভা পর্যন্ত সব প্রতিনিধিই দুর্নীতি করলেও দেশপ্রেম ছিল তাঁদের কাছে সবার প্রথমে। আর এ জন্যই তো ভারত সব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে তরতর করে; আর আমরা মধ্যযুগীয় গণতন্ত্রের দিকে পা বাড়িয়েছি।’
আবার কেউ কেউ দ্বিমতও করেছেন। একজন পাঠক টেলিফোন করে বলেছেন, আপনার কথায় যুক্তি থাকলেও মেনে নিতে পারলাম না। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কেন পারলেন না? তাঁর জবাব, ভারতের উদাহরণ এখানে খাটবে না। সেখানে স্বাধীনতার বিরোধী কোনো দল বা নেতা নেই। এখানে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতারা কীভাবে বসবেন’? আমি বললাম, কোনো ব্যক্তি বা দল যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তার তো রাজনীতি করারই অধিকার থাকা উচিত নয়। বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেই সবাইকে রাজনীতি করতে হবে। ভদ্রলোক বললেন, তারপরও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ কীভাবে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর মতো দলের সঙ্গে বসবে? জবাবে বললাম, একাত্তরের অপকর্মের জন্য জামায়াতের নেতাদের বিচার ও ফাঁসি হয়েছে। দল হিসেবে জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে সরকারের উচিত হবে তাকে নিষিদ্ধ করা। কিন্তু সরকার সেটি করছে না। আর যেহেতু দলটি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত নয়, সেহেতু নির্বাচনী আলোচনায় জামায়াতের অংশগ্রহণেরও প্রশ্ন আসে না। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে বসতে অসুবিধা কোথায়? তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, যে দলের নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর চায়ের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন, তাঁর পুত্রের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী সমবেদনা জানাতে গেলে দরজা বন্ধ করে দেন, সেই দলের সঙ্গে কোনো আলোচনা হতে পারে না। আমি তাঁকে বলি, বিএনপি ওই দুই ঘটনায় খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। নিম্ন রুচির পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু তারপরও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। দল হিসেবে বিএনপি ভুল করে থাকলে তার কাফফারা তারা দেবে। কিন্তু আওয়ামী লীগও যে ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন করে সামরিক শাসকের দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টিরই পঙ্‌ক্তিভুক্ত হলো। তার জবাব কী? 
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করল না। নির্বাচনের পরে বিএনপি ও তাদের জোটের প্রার্থী হিসেবে যাঁরা নির্বাচিত হবেন, তাঁদের সঙ্গেও কি আওয়ামী লীগ বাৎচিত বন্ধ রাখবে? সংসদীয় কমিটিতে কিংবা অধিবেশনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাংসদেরা কি একসঙ্গে বসবেন না? যদি সেখানে তাঁরা বসতে পারেন, তাহলে বাইরে কেন বসতে পারবেন না? আর আওয়ামী লীগের নেতারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের সঙ্গে কখনো বসেননি, তা তো নয়। নব্বই দশকের মাঝামাঝি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন কিন্তু তাঁরা জাতীয় পার্টি ও জামায়াতকে নিয়েই করেছিল।
আজ আওয়ামী লীগের নেতারা যে যুক্তিতে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে বসতে চান না, সেই একই যুক্তিতে এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গেও বসা যায় না। দুই সামরিক শাসকের কোনো শাসকই আওয়ামী লীগকে ছাড় দেয়নি। এরশাদের ক্ষমতার উৎসই ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিভাজন ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি। দুই দলের অনেক নেতাকে ভাগিয়ে তিনি মন্ত্রী করেছিলেন।
দুই দলের আলোচনার প্রশ্ন এলেই আওয়ামী লীগের নেতারা একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা তোলেন। কিন্তু এরশাদ আমলের কথা বলেন না। বিএনপির আমলে যেমন একুশ আগস্টের মতো ঘৃণ্য ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তেমনি এরশাদের সময়ও ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনার জনসভা বানচাল করতে চট্টগ্রামে ‘গণহত্যা’ চালানো হয়েছিল। একুশ আগস্টের কাফফারা বিএনপি দিয়েছে। কিন্তু এরশাদকে জবাবদিহি করতে হয়নি।
সম্প্রতি বিএনপির একজন নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি স্বীকার করেন, খালেদা জিয়ার প্রথম সরকার যেভাবে বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার নীতি নিয়েছিল, দ্বিতীয়বার সেটি না করা ছিল বড় ভুল। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগও সেই ভুলের ধারায় চলেছে। এই শোধ–প্রতিশোধের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে মহাসড়কেই হাঁটুক না কেন, গণতন্ত্রের সড়কটি সংকুচিত হতে হতে অন্ধ গলিতে হারিয়ে যাবে। কে কত বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় আছেন বা ছিলেন তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাঁরা কী রেখে যাচ্ছেন?
গত ২৩ মে নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচনের জন্য একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। এই রোডম্যাপ অনুযায়ী তারা নির্বাচনের বিষয়ে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করবে। নভেম্বর পর্যন্ত এই সংলাপ চলবে বলে জানিয়েছে ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, আইন সংস্কার, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নতুন নিবন্ধন, ভোটকেন্দ্র, ইসির সক্ষমতা বাড়ানো ও সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি—এই সাত বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
সংবিধান অনুযায়ী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের আগে নির্বাচন হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি না নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি নেই। দায়িত্ব নেওয়ার পর বর্তমান কমিশন নড়েচড়ে বসেছে। কূটনীতিকদের সঙ্গেও তারা আলোচনা করছে।  
কিন্তু নির্বাচনের প্রধান যে নিয়ামক শক্তি রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে কোনো আলোচনা বা সংলাপ করার প্রয়োজন বোধ করছে না। কেন? গত ৪৬ বছরে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য অনেক। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা এক কদমও এগোতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই নিতে হবে। নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে দুই পক্ষই মাঠ গরম করতে শুরু করেছে। এক পক্ষ বলছে, ২০১৪ সালের মতো ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেওয়া হবে না। আরেক পক্ষ বলছে, তাদের শর্তেই আগামী নির্বাচন হবে।
এই পাল্টাপাল্টি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপটি উল্টে দেবে না তো?
কমেন্ট করে জানাবেন।

No comments:

Post a Comment

চড়কা, চরকা