করের বোঝার বাজেট জনগণমুখী কীভাবে!
বাজেট বিশাল অঙ্কের, কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে হয় না। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের সঙ্গে তুলনা করলে এটা একটা বড় উল্লম্ফন। আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বাজেট বাস্তবায়নের যে দক্ষতা, তার যে খুব বেশি উন্নয়ন হয়েছে তা কিন্তু নয়। এমন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিয়ে কার্যকরীভাবে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
বাজেট ঘাটতি সহনীয় হয়, যদি টাকাটা যথাযথ কাজে লাগানো যায়। যদি দুর্নীতি ও অপচয় না হয়, জবাবদিহি থাকে। কিন্তু এবারের বাজেট ঘাটতি হবে বিশাল। আর এর বোঝা চাপবে জনগণের ওপর। এটা তো গ্রহণযোগ্য নয়।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক, জনগণমুখী বাজেট। কিন্তু কোথায়? এর বাস্তবায়নের উদ্যোগ ঘোষিত বাজেটে নেই। করের বোঝা চাপিয়ে বাজেট জনগণমুখী হয় কীভাবে।
রাজস্ব আয় বাড়াতে সহজ উপায়ে ভ্যাট চাপানো হয়েছে। এটা এত সহজে কি বাস্তবায়ন করা যাবে? সব ব্যবসাকে তো সহজেই স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেটেড করা যাবে না। সংস্কার না করে ভ্যাট চাপিয়ে দেওয়াটাও ঠিক হয়নি। শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা সব বোঝা চাপিয়ে দেবে ভোক্তার ওপর। এতে সরকারের আয় বাড়বে হয়তো, কিন্তু পুরোটাই যাবে সাধারণ ভোক্তার পকেট থেকে। ১৯৯১ থেকেও তো ভ্যাট আছে, এবার জোর করে পুরোটাই চাপানো ঠিক হয়নি। এভাবে পরোক্ষ কর না বাড়িয়ে করজাল বাড়াতে পারত। মফস্বলের অনেক ব্যবসায়ী কর দেন না, এ ছাড়া টিন সার্টিফিকেট থাকলেও অনেকে কর দেন না। এসব ঠিক করতে হলে এনবিআরের সংস্কার দরকার। তা না করে সহজ উপায়ে ভোক্তাদের ওপর কর চাপানো হয়েছে। এতে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হবে। কর্মকর্তারা দোকানে দোকানে যাবেন, ব্যবসায়ীরাও নথিপত্র ঠিক রাখবেন না।
প্রস্তাবিত বাজেটে এক লাখ কোটি টাকা ঘাটতি ধরা হয়েছে। বিদেশি ঋণ, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এসব অর্থায়ন সংগ্রহ করা হবে। এত বড় ঘাটতি রেখে বাজেট হওয়ায় সব সরকারই দেনার বোঝা বাড়িয়ে চলছে। আবার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সরকার বিভিন্নভাবে কর আদায় করছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেবা জনগণ পাচ্ছে না। জীবনযাত্রার মানও বাড়ছে না। সরকারি বাজেটের সুবিধা হলো, যত টাকা লাগে খরচ করব, জোর করে জনগণ থেকে টাকা আদায় করব। ব্যক্তিগত বাজেট হলে এটা করা যায় না।
হঠাৎ করে কী এমন সক্ষমতা তৈরি হলো যে এত বড় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। বলা হচ্ছে তদারক করবে, কে দেখবে এসব। কাজের গুণগত মান, টাকার যথাযথ ব্যবহার হয়েছে কি না তা কি দেখা যাবে? একটা চার বছরের প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে আট বছর লাগে, এটা শুধু টাকার অপচয়।
ব্যাংকের হিসাব থেকে বেশি টাকা কেটে নেওয়ার উদ্যোগটাই অদ্ভুত। এ ধরনের আবগারি শুল্ক করা হয় কোনো খারাপ অভ্যাস থেকে বিরত রাখার জন্য। সিগারেট, মদ এসব পণ্যে করা যেতে পারে। উল্টো আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে ব্যাংক হিসাবের ওপর। মনে হচ্ছে ব্যাংকে টাকা রাখার প্রয়োজন নেই। এর পুরো প্রভাব পড়বে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত গ্রাহকদের ওপর। এভাবে সরাসরি হিসাব থেকে কেটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই যুক্তিসংগত হতে পারে না। এর ফলে জনগণ ব্যাংকবিমুখ হয়ে পড়বে। বলা হচ্ছিল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো হবে, ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন বাড়বে। অথচ আবগারি কর বাড়ানোর এমন সিদ্ধান্ত তো পুরো উল্টো হবে। গ্রামেগঞ্জে নতুন করে সমিতি গড়ে উঠবে, সেখানেই চলে যাবে সব টাকা।
বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে বড় অংশই যাবে বেতন-ভাতা ও ভবন নির্মাণে। শিক্ষার উপকরণ, ল্যাব নির্মাণে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে তেমন বরাদ্দ নেই। শিক্ষার গুণগত মান ও পরিধি বাড়াতে তেমন উদ্যোগ নেই। সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। এটা তো মৌলিক অধিকার। স্বাস্থ্যের কারণে কেউ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে যাবে, আবার অসুখ হলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে আসবেন, এভাবে তো চলতে পারে না। আফ্রিকার দেশও প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে আমাদের চেয়ে তিন গুণ বেশি খরচ করে।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। তবে এর বড় অংশ চলে যাবে পেনশন, গ্র্যাচুইটি খাতে। দরিদ্রদের আসল যে নিরাপত্তা দরকার, বয়স্ক ভাতা তো বাড়েনি। অর্থাৎ যাদের নিরাপত্তা আছে তারাই বেশি সুবিধা পাবে। দরিদ্রদের নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। বড় বড় প্রকল্পের পাশাপাশি গ্রামগঞ্জের সড়কগুলো সংস্কারে বরাদ্দ প্রয়োজন।
জনগণের টাকা দিয়ে সরকারি ব্যাংকের অনিয়ম অদক্ষতার ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে কোন যুক্তিতে। তার মানে কি সরকারি ব্যাংকগুলোকে অনিয়ম করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এটা জনগণের টাকা, এসব টাকা অপচয় করা কোনো অধিকার তো নেই।
No comments:
Post a Comment