সু চি আর নেই সেই সু চি
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় কয়েক মেয়াদে প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দী ছিলেন সু চি। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অহিংস লড়াই-সংগ্রামের নজির স্থাপনের জন্য ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পান তিনি।
২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পান সু চি। সেদিন মনে হয়েছিল, এবার বুঝি মিয়ানমারে গণতন্ত্র আসবে। সু চির হাত ধরে তাঁর দেশে মানবাধিকার সমুন্নত হবে।
ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে থাকে মিয়ানমার। সবার মন আশার আলো জ্বলে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভাবতে থাকে, দেশটিতে শান্তি-স্থিতিশীলতা আসতে বেশি দেরি নেই।
২০১৫ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল জয় পায়। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে দলটি ক্ষমতা নেয়।
সাংবিধানিক বিধিনিষেধের কারণে প্রেসিডেন্ট হতে ব্যর্থ হন সু চি। এই পদে তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী থিন কিউকে বসান। সু চি নিজে হন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পদ যা-ই হোক না কেন, কার্যত সু চিই সরকার চালান।
সু চির মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু সে আশায় গুঁড়ে বালিই বটে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে অনেকটা মানিয়ে চলছেন সু চি। সেনাবাহিনীর অবস্থানের বিরুদ্ধে যায়—এমন কাজ থেকে বিরত থাকছে তাঁর সরকার।
গত বছরের অক্টোবরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশের সীমান্তচৌকিতে সন্ত্রাসী হামলা হয়। হামলার জেরে রাখাইনে অভিযান শুরু করে দেশটির সেনা-পুলিশ। অভিযানের মূল লক্ষ্য হয় রোহিঙ্গারা।
রাখাইনে অভিযানে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিস্তর অভিযোগ সামনে আসতে থাকে। জাতিগত নিধনের অভিযোগ ওঠে।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, রাখাইনে সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ ৭৪ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, মিয়ানমারে সু চির দল ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকটি সংঘাতে ১ লাখ ৬০ হাজারের মতো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
শান্তিতে নোবেল পাওয়া সু চি মানবাধিকারের ঝান্ডা তুলে ধরবেন—এমনই তো হওয়ার কথা ছিল! তবে দুঃখজনক হলো, রোহিঙ্গা নিপীড়নের ব্যাপারে তিনি বরাবরই চুপ। উল্টো বড় গলায় অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন তিনি।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন স্পষ্ট করে বলেছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে সু চির সরকার উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দেশটির বর্তমান সরকারের আচরণেরও নিন্দা করেছে কমিশন।
রাখাইনে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের প্রবেশ করতে দিচ্ছে না মিয়ানমার। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মানবাধিকার রক্ষার বাধ্যবাধকতাগুলো তারা এড়িয়ে যাচ্ছে।
রোহিঙ্গা দমন-পীড়নের অভিযোগ তদন্তে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত নাকচ করেছেন সু চি। গত মার্চে জাতিসংঘের এই কাউন্সিল রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে দেশটিতে একটি মিশন পাঠাতে সম্মত হয়েছিল। এখন সু চি বলছেন, জাতিসংঘের প্রস্তাবের সঙ্গে তাঁরা একমত নন।
সম্প্রতি দেশটির কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে নতুন করে শান্তি আলোচনা শুরু করেন সু চি। এই আলোচনায় রোহিঙ্গারা নেই।
গণতন্ত্র-মানবাধিকারের ‘মূর্ত প্রতীক’ বলে পরিচিত সু চিকে চিনতে এখন বড্ড কষ্ট হয়। তিনি ‘রাজনীতি’ শিখে গেছেন। ভোটের রাজনীতি, ক্ষমতার রাজনীতি। সু চি আর নেই সেই সু চি।
No comments:
Post a Comment