আমার বাঙালি দর্শন
সৈয়দ আসিফ শাহকার জাতিতে পাঞ্জাবি। তিনি ওয়ালী খানের ছাত্রসংগঠন পাঞ্জাব স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন। তাঁকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয়। ১৯৭৭ সালে তিনি সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ দেয়।
ছেলেবেলায় বাঙালি জাতির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ‘ভুখা বাংলা’ শব্দটির মাধ্যমে। আমাদের কাছে এ শব্দটি বাঙালিদের দারিদ্র্যই প্রকাশ করে। যখন কোনো ব্যক্তির দারিদ্র্য ও ক্ষুধার চরম পরিণতির উদাহরণ দিতে হতো, তখনই এই ‘ভুখা বাংলা’ শব্দটি চলে আসত। বাঙালি বলতেই দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত, শীর্ণ দেহ, জীর্ণ কাপড় পরা, খালি পায়ে ভিক্ষা চাইতে থাকা ক্ষীণকায় শ্যামবর্ণের কোনো লোকের অবয়ব ভেসে ওঠে।
১৯৬০ সালে জীবনে আমার প্রথমবার কোনো জীবিত ও জাগ্রত বাঙালিকে দেখার সৌভাগ্য হয়। তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশের মথুরা রাজ্যের বড়পা গ্রামে তিন কক্ষের একটি হাসপাতালে ডাক্তার হয়ে এসেছিলেন। সেটি নামেমাত্রই ছিল হাসপাতাল। না ছিল ওষুধ, না কোনো কর্মচারী। সেখানে কেউ কোনো দিন ডাক্তার দেখেনি। কম্পাউন্ডারই ছিল ডাক্তারের ভূমিকায়। ওই বাঙালিই ছিলেন সেখানকার প্রথম ডাক্তারিবিদ্যা পাস করা পেশাদার চিকিৎসক। তিনি এসেই হাসপাতালটিকে কর্মচঞ্চল করে তুললেন। ওষুধপত্র এল, কর্মচারীরা কাজে এল। ধীরে ধীরে রোগীদের ভিড় বাড়তে লাগল। স্মিতমুখ, নির্লোভ, কঠোর পরিশ্রমী, বিনয়ী, সৌহার্দ্যপূর্ণ হৃদয়ের অধিকারী সেই বাঙালি ডাক্তার দরিদ্রদের বিনা মূল্যে টিকা দিতেন। তিনি গ্রামবাসীর সুহৃদ হয়ে উঠলেন। ‘ভুখা বাংলা’র বাঙালি ডাক্তার ওই গ্রামের তরুণদের আদর্শ হয়ে উঠলেন।
তারপর কত–না কাহিনির যে জন্ম হলো। ডাক্তারের আধ্যাত্মিক শক্তিও আছে, এই বিবেচনায় কিছু লোক তাঁকে পীর মানতে শুরু করল। তাঁর হাত ধরেই বাঙালিদের সঙ্গে জড়িত কুৎসিত চেহারার অপবাদটিও ঘুচে গেল। না শীর্ণকায়, না কালো; বরং তাঁকে দেখে পাঞ্জাবিদের মতোই শক্তসামর্থ্য ও সুদর্শন মনে হতো। তিনি অনেক তরুণীরও আদর্শ ছিলেন। কতজনের হৃদয়ে আরক্ত প্রেমের সঞ্চার তিনি ঘটিয়েছেন, তা কে জানে। কিন্তু এলাকার প্রায় সব সুন্দরীই যে তাঁর প্রেমে আকণ্ঠ ডুবে থাকত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এভাবে বাঙালি ডাক্তার তাঁর জাতি সম্পর্কে সবার নেতিবাচক চিন্তার অবসান ঘটালেন।
এই বাঙালি ডাক্তারের প্রভাবেই আবু খুরশীদ আলমের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। খুরশীদ দিনাজপুরে ইকবাল হাইস্কুলে পড়ত। ছোটদের জন্য প্রকাশিত একটি পত্রিকার ‘কলম-বন্ধু’ অংশে তার ঠিকানা পাই। আমরা দুজন কলম-বন্ধু হয়েছিলাম। প্রতি সপ্তাহেই আমি খুরশীদকে একটি করে চিঠি লিখে প্রত্যুত্তরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। এভাবেই খুরশীদ আমার জীবনের অচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হলো। ম্যাট্রিক পাসের পরে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আমাদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল, যদিও পরে সেটি বিচ্ছিন্নতায় রূপ নেয়।
‘ভুখা বাংলা’ এখন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো স্বাধীন–সার্বভৌম জাতি। আর এত বছর পর খুরশীদও নিশ্চয়ই বার্ধক্যে পৌঁছেছে। কিন্তু আমি তো এখনো তাকে সেই ইকবাল হাইস্কুলে পড়ুয়া ছবিতেই আঁকড়ে ধরে রেখেছি। অবচেতনেও তার স্মৃতি আমাকে কাতর করে তোলে। ২০১২ সালে যখন আমি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া সম্মাননা নিতে ঢাকায় গেলাম, তখনো আমার চোখ তাকে খুঁজে ফিরেছে। আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল দিনাজপুরে গিয়ে তাকে খুঁজে বের করব, কিন্তু সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। এখনো আমি আশাবাদী, জীবিত খুরশীদের সঙ্গে অবশ্যই আমার দেখা হবে, আর সে সময় আমি ১৯৬২ সাল থেকে তার প্রতি আমার লালিত অনুরাগ প্রকাশ করে ভারমুক্ত হব।
ম্যাট্রিক পাসের পর আমি লাহোরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হই। কলেজ হোস্টেলে আমার সঙ্গে জামাল নামের এক বাঙালি ছাত্রের পরিচয় হয়। সে ছিল বিজ্ঞানের ছাত্র। কলেজে আর কেউ বাংলা না জানায় অন্যদের সঙ্গে সে উর্দু আর ইংরেজিতে কথা বলত। বেশির ভাগ ছাত্রই ছিল নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা এবং উর্দু মাধ্যমের পড়ুয়া, কথা বলত পাঞ্জাবিতে। জামাল তাদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলত, কিন্তু পাঞ্জাবি ছাত্রদের কেউই তার ইংরেজি বুঝত না। তাই তারা ব্যাপারটি গোপন রাখতে চাইত। এ কারণে তারা জামালকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। ব্যাপারটি জামালের দৃষ্টিগোচর হলে স্বাভাবিকভাবেই সে উর্দুতে কথা বলতে শুরু করল। ভাষাটি সে ভালোভাবে রপ্ত করতে পারেনি। তা ছাড়া কয়েকটি উর্দু শব্দের উচ্চারণ সে বাংলার মতো করে করত। পাঞ্জাবি ছাত্রদের তা বোধগম্য হতো না। জামাল আমেরিকান, ইংরেজ বা আরব হলে হয়তো ছাত্ররা তার টুটাফাটা উর্দুকে গুরুত্ব দিত। কিন্তু সে তো ‘ভুখা বাঙালি’। এ কারণে ছাত্ররা ব্যাপারটি আমলে না নিয়ে তাকে বরং উপহাস করতে শুরু করল। এর ফলে জামালের সঙ্গে ধীরে ধীরে তাদের দূরত্ব বাড়তে লাগল।
আমার সঙ্গে যখন জামালের পরিচয় হয়, তখন সে একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার শিকার। প্রায় অর্ধ উন্মাদ, এমনকি নেশাদ্রব্যেও আসক্ত হয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও শিল্প, সাহিত্য ও রাজনীতি সম্পর্কে জামালের ছিল অগাধ জ্ঞান। অনেক বিষয়েই তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান ছিল। সে প্রায়ই আমাকে দুঃখ করে বলত যে সে পাকিস্তানি হলেও ভাষার কারণে বিদেশি এবং নিজ বাসভূমে পরবাসী ধরনের আচরণের শিকার। এ এক আজব দেশ, যেখানে সংখ্যাগুরুর সঙ্গেই সংখ্যালঘুর মতো সাম্প্রদায়িক আচরণ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষাকে মনে করা হয় বিদেশি ভাষা। জামাল বেশি দিন এ নির্মমতা সহ্য করতে পারেনি। একদিন সে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। সেই মৃতদেহ কয়েক দিন পর্যন্ত তার কক্ষে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে ছিল। পরে খবরটি জানাজানি হলে এক খ্রিষ্টান জমাদার গলিত লাশটির গোসল ও জানাজাবিহীন দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করে।
জামালের মৃত্যু ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানেরই মৃত্যুর প্রতীক। সে আমাকে প্রায়ই বলত, তার দেশের সঙ্গে পাকিস্তানি শাসকেরা যে অনাচার ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্য করছে আর বেশি দিন তারা সেটা করতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তা ও ভাষা কেড়ে নিয়ে এ দেশকে রক্ষা করা যাবে না। এ দেশকে রক্ষা করার মূলমন্ত্র হতে পারে গণপ্রজাতন্ত্রী ফেডারেল পাকিস্তান, যার মেলবন্ধনের ভাষা হবে বাংলা।
২. বৈষম্যের শিকার বাঙালি
পাঞ্জাবি ভাষায় একটি বিখ্যাত প্রবাদ আছে, ‘ইনসান কো রাস্তে পর চলনে সে ইয়া ওয়াসেতাহ পড়নে সে ইলম হোতা হ্যায়।’ অর্থাৎ, পথ চলতে গিয়েই মানুষের পথ ও পথে সৃষ্ট সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন হয়। এ প্রবাদটি আমি বহুবার শুনেছি। কিন্তু যত দিন না আমাকে এ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তত দিন অবধি এটি আমার বোধগম্য হয়নি। এ প্রসঙ্গে আমার ১৯৭৭ সালের কথা মনে পড়ে যায়। সে সময় আমাকে সবকিছু ছেড়ে সুইডেনে চলে আসতে হয়েছিল। এ ঘটনায় আমার উপলব্ধি হলো, আল্লাহ না করুক, কাউকে যেন মুসাফিরের জীবনযাপন করতে না হয়।
দেশত্যাগে আমি বাধ্য হয়েছিলাম। ১৯৭১ সালে বাঙালিদের সহযোগিতার অপরাধে কারা নির্যাতন, অবমাননা ও অপদস্থতার সঙ্গে সঙ্গে ‘গাদ্দার’ খেতাবটিও অর্জন করেছিলাম। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে পাকিস্তানি টিভিতে প্রযোজক হিসেবে যোগ দিতে পেরেছিলাম বটে, কিন্তু গাদ্দার খেতাবটি আমার পিছু ছাড়েনি। এ কারণে আমাকে সব সময় নিদারুণ বৈষম্য ও হুমকির মুখোমুখি হতে হতো। অবশেষে ১৯৭৭ সালে ভুট্টো সরকারের শাসনকালে আমি মাতৃভূমি পাকিস্তান ছাড়তে বাধ্য হই।
সুইডেনে আসার পর সবকিছুই বদলাতে শুরু করল। স্থান, কাল, আবহাওয়া, ঋতুবৈচিত্র্য, পরিবেশ-পরিস্থিতি, মানুষজন, ভাষা, জীবনযাপন-পদ্ধতি, এমনকি আমার আত্মপরিচয়টুকুও। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ছিল নিজের সম্মানজনক পরিচয়টি অন্যের দৃষ্টিতে হারিয়ে যাওয়া। পাকিস্তানে বিচিত্র পরিচয়ে আমি পরিচিত ছিলাম। সৈয়দ বংশের এক জমিদারনন্দন, ছাত্রনেতা, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, টিভি প্রযোজক। সুইডেনে আসার পর সবকিছু হারানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয়টুকুও পরিবর্তিত হয়ে এক প্রবাসী ভিনদেশি পথিক আর কালো খুপরিওয়ালায় পর্যবসিত হলো। ‘কালো খুপরি’, মানে ‘কালো কেশধারী’ আর সুইডিশ বংশোদ্ভূত—সুইডেনে এই দুই পরিচয় জাতিবৈষম্যের পরিচায়ক। ইংল্যান্ডে পাকিস্তানিদের জন্য ব্যবহৃত ‘পাকি বাস্টার্ড’ আর আমেরিকায় কালোদের জন্য ব্যবহৃত ‘নিগ্রো’ শব্দটির মতো সুইডেনে কালো খুপরি শব্দটি অবহেলা ও বঞ্চনার প্রতীক। শব্দটি ঘৃণা ও অবজ্ঞার নিষ্পেষণযন্ত্রের মতোই মানুষের মধ্যে হীনম্মন্যতাবোধ তৈরি করে তাকে অন্য জগতের বাসিন্দা করে তোলে। আর মানবাধিকার ভৃত্যের অধিকারে পরিণত হয়।
ছেলেবেলা থেকে আমার মধ্যে বাঙালিদের সম্পর্কে কিছু ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল। আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম, পাকিস্তানের জন্য বাঙালি জাতি একটা বোঝা। তারা একেবারেই নির্বোধ ও অযোগ্য প্রকৃতির—শুধুই ঝামেলা আর ঝামেলা। কুৎসিত, কদাকার, শীর্ণদেহী ও দুর্বল এই জাতির কিছুই নেই। ওরা ভীরু ও কাপুরুষ, তদুপরি লড়াই করতে জানে না বলে সৈনিক হওয়ারও অযোগ্য। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর দিয়ে হরহামেশাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বয়ে যেত। বাঙালিরা তাতে কীটপতঙ্গের মতো মারা যেত। দুর্ভিক্ষ ও অসুখ-বিসুখ থেকে জীবিতদের বাঁচাতে পাকিস্তান সরকারের অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। এতে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব তো পড়ছেই, পাশাপাশি দারিদ্র্যের সংকটও সৃষ্টি হচ্ছে।
কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণের পর দেখলাম, দূর থেকে বাঙালিদের ভীতসস্ত্রস্ত মনে হলেও তারা আসলে তা নয়। তাদের বুকে সর্বদাই প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে তারা অসহায় জীবনযাপন করে। কেউ অফিসার পদে থাকলেও ভয়ে পাঞ্জাবি মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে না।
এ রকম একজন ভুক্তভোগী ছিলেন জামান আলী খান। তিনি বিখ্যাত চলচ্চিত্রাভিনেত্রী সুলতানা জামানের সাবেক স্বামী। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তান টিভিতে প্রযোজকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। চাকরির সুবাদেই পাকিস্তানের দোসর হয়ে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করে গেছেন। এর প্রতিদানে পাকিস্তান টেলিভিশনের জেনারেল ম্যানেজারের পদ পান এবং চাটুকারিতায় পঞ্চম বাঙালি কলামিস্ট উপাধিতেও ভূষিত হন। তবু এসব আপাত-সাফল্যের পরও অন্য পাঞ্জাবি ও উর্দুভাষীদের তুলনায় টেলিভিশনে তাঁর পিয়ন ছিল কম। সব সময়ই তাঁকে কাজ করতে হতো ভয়ে ভয়ে। তাঁর প্রসঙ্গ উঠলেই লাহোর টেলিভিশনের কর্মকর্তারা তাঁকে ‘বাঙালি কুত্তা’ বলে ডাকত।
টেলিভিশনে এক বাঙালি নৃত্যশিল্পী ছিলেন। অন্যদের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও কোনো সাধারণ অনুষ্ঠানে নাচতে হলে তাঁকে ঘুষ দিতে হতো, কাউকে কাউকে ‘খুশি’ করতে হতো। অথচ টিভির জেনারেল ম্যানেজার জামান আলী খান নিজেই ছিলেন একজন বাঙালি।
১৯৭১ সালের পরে কয়েক হাজার বাঙালি সৈন্য পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিল। তারা পাঞ্জাবি সৈন্যদের মতোই উর্দি পরত এবং তাদের সঙ্গে নানা কাজ করত। এই সৈন্যরা বাংলাদেশের অন্য বাঙালিদের মতো মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি। পাকিস্তানের অন্য সৈন্যদের সঙ্গে এই বাঙালি সৈন্যদের জার্মান ভিক্ষুক-শিবিরের ইহুদি বন্দীদের মতো জীবনযাপন করতে হতো। তারা ছিল অবজ্ঞা আর ঘৃণার প্রতীক।
১৯৭১ সালের আগে যখনই আমি বাঙালিদের ওপর আরোপিত বৈষম্য নিয়ে ভাবতাম, পাকিস্তানকে আমার দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার মতো মনে হতো, যেখানে সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের কাছে নিগৃহীত ও ভৃত্যরূপে বিবেচিত। পাঞ্জাবি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, ‘বন্ধ কর রাজ পাক্কে নেহি হোতে।’ এর মানে হলো, ‘স্বৈরশাসন কখনোই স্থায়ী হয় না।’ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—মাত্র ২৪ বছর এই স্বৈরাচারী রাজত্ব টিকে ছিল। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি এ শ্রেণিবৈষম্য থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানসহ পৃথিবীর কত দেশের শত শত মানুষ এখনো শ্রেণিবৈষম্যের এই বন্দিত্ব ভোগ করতে বাধ্য হচ্ছে।
আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ নিজের অতীত থেকে শিক্ষা নেবে এবং শ্রেণিবৈষম্য থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি সব জায়গায় সব রকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। এ যুদ্ধে তাদের অবশ্যই লড়াই করতে হবে। এটা তো তাদের আবশ্যকীয় কর্তব্য ও দায়িত্বও বটে।
পাঞ্জাবি ভাষায় একটি বিখ্যাত প্রবাদ আছে, ‘ইনসান কো রাস্তে পর চলনে সে ইয়া ওয়াসেতাহ পড়নে সে ইলম হোতা হ্যায়।’ অর্থাৎ, পথ চলতে গিয়েই মানুষের পথ ও পথে সৃষ্ট সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন হয়। এ প্রবাদটি আমি বহুবার শুনেছি। কিন্তু যত দিন না আমাকে এ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তত দিন অবধি এটি আমার বোধগম্য হয়নি। এ প্রসঙ্গে আমার ১৯৭৭ সালের কথা মনে পড়ে যায়। সে সময় আমাকে সবকিছু ছেড়ে সুইডেনে চলে আসতে হয়েছিল। এ ঘটনায় আমার উপলব্ধি হলো, আল্লাহ না করুক, কাউকে যেন মুসাফিরের জীবনযাপন করতে না হয়।
দেশত্যাগে আমি বাধ্য হয়েছিলাম। ১৯৭১ সালে বাঙালিদের সহযোগিতার অপরাধে কারা নির্যাতন, অবমাননা ও অপদস্থতার সঙ্গে সঙ্গে ‘গাদ্দার’ খেতাবটিও অর্জন করেছিলাম। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে পাকিস্তানি টিভিতে প্রযোজক হিসেবে যোগ দিতে পেরেছিলাম বটে, কিন্তু গাদ্দার খেতাবটি আমার পিছু ছাড়েনি। এ কারণে আমাকে সব সময় নিদারুণ বৈষম্য ও হুমকির মুখোমুখি হতে হতো। অবশেষে ১৯৭৭ সালে ভুট্টো সরকারের শাসনকালে আমি মাতৃভূমি পাকিস্তান ছাড়তে বাধ্য হই।
সুইডেনে আসার পর সবকিছুই বদলাতে শুরু করল। স্থান, কাল, আবহাওয়া, ঋতুবৈচিত্র্য, পরিবেশ-পরিস্থিতি, মানুষজন, ভাষা, জীবনযাপন-পদ্ধতি, এমনকি আমার আত্মপরিচয়টুকুও। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ছিল নিজের সম্মানজনক পরিচয়টি অন্যের দৃষ্টিতে হারিয়ে যাওয়া। পাকিস্তানে বিচিত্র পরিচয়ে আমি পরিচিত ছিলাম। সৈয়দ বংশের এক জমিদারনন্দন, ছাত্রনেতা, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, টিভি প্রযোজক। সুইডেনে আসার পর সবকিছু হারানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয়টুকুও পরিবর্তিত হয়ে এক প্রবাসী ভিনদেশি পথিক আর কালো খুপরিওয়ালায় পর্যবসিত হলো। ‘কালো খুপরি’, মানে ‘কালো কেশধারী’ আর সুইডিশ বংশোদ্ভূত—সুইডেনে এই দুই পরিচয় জাতিবৈষম্যের পরিচায়ক। ইংল্যান্ডে পাকিস্তানিদের জন্য ব্যবহৃত ‘পাকি বাস্টার্ড’ আর আমেরিকায় কালোদের জন্য ব্যবহৃত ‘নিগ্রো’ শব্দটির মতো সুইডেনে কালো খুপরি শব্দটি অবহেলা ও বঞ্চনার প্রতীক। শব্দটি ঘৃণা ও অবজ্ঞার নিষ্পেষণযন্ত্রের মতোই মানুষের মধ্যে হীনম্মন্যতাবোধ তৈরি করে তাকে অন্য জগতের বাসিন্দা করে তোলে। আর মানবাধিকার ভৃত্যের অধিকারে পরিণত হয়।
ছেলেবেলা থেকে আমার মধ্যে বাঙালিদের সম্পর্কে কিছু ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল। আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম, পাকিস্তানের জন্য বাঙালি জাতি একটা বোঝা। তারা একেবারেই নির্বোধ ও অযোগ্য প্রকৃতির—শুধুই ঝামেলা আর ঝামেলা। কুৎসিত, কদাকার, শীর্ণদেহী ও দুর্বল এই জাতির কিছুই নেই। ওরা ভীরু ও কাপুরুষ, তদুপরি লড়াই করতে জানে না বলে সৈনিক হওয়ারও অযোগ্য। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর দিয়ে হরহামেশাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বয়ে যেত। বাঙালিরা তাতে কীটপতঙ্গের মতো মারা যেত। দুর্ভিক্ষ ও অসুখ-বিসুখ থেকে জীবিতদের বাঁচাতে পাকিস্তান সরকারের অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। এতে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব তো পড়ছেই, পাশাপাশি দারিদ্র্যের সংকটও সৃষ্টি হচ্ছে।
কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণের পর দেখলাম, দূর থেকে বাঙালিদের ভীতসস্ত্রস্ত মনে হলেও তারা আসলে তা নয়। তাদের বুকে সর্বদাই প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে তারা অসহায় জীবনযাপন করে। কেউ অফিসার পদে থাকলেও ভয়ে পাঞ্জাবি মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে না।
এ রকম একজন ভুক্তভোগী ছিলেন জামান আলী খান। তিনি বিখ্যাত চলচ্চিত্রাভিনেত্রী সুলতানা জামানের সাবেক স্বামী। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তান টিভিতে প্রযোজকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। চাকরির সুবাদেই পাকিস্তানের দোসর হয়ে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করে গেছেন। এর প্রতিদানে পাকিস্তান টেলিভিশনের জেনারেল ম্যানেজারের পদ পান এবং চাটুকারিতায় পঞ্চম বাঙালি কলামিস্ট উপাধিতেও ভূষিত হন। তবু এসব আপাত-সাফল্যের পরও অন্য পাঞ্জাবি ও উর্দুভাষীদের তুলনায় টেলিভিশনে তাঁর পিয়ন ছিল কম। সব সময়ই তাঁকে কাজ করতে হতো ভয়ে ভয়ে। তাঁর প্রসঙ্গ উঠলেই লাহোর টেলিভিশনের কর্মকর্তারা তাঁকে ‘বাঙালি কুত্তা’ বলে ডাকত।
টেলিভিশনে এক বাঙালি নৃত্যশিল্পী ছিলেন। অন্যদের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও কোনো সাধারণ অনুষ্ঠানে নাচতে হলে তাঁকে ঘুষ দিতে হতো, কাউকে কাউকে ‘খুশি’ করতে হতো। অথচ টিভির জেনারেল ম্যানেজার জামান আলী খান নিজেই ছিলেন একজন বাঙালি।
১৯৭১ সালের পরে কয়েক হাজার বাঙালি সৈন্য পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিল। তারা পাঞ্জাবি সৈন্যদের মতোই উর্দি পরত এবং তাদের সঙ্গে নানা কাজ করত। এই সৈন্যরা বাংলাদেশের অন্য বাঙালিদের মতো মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি। পাকিস্তানের অন্য সৈন্যদের সঙ্গে এই বাঙালি সৈন্যদের জার্মান ভিক্ষুক-শিবিরের ইহুদি বন্দীদের মতো জীবনযাপন করতে হতো। তারা ছিল অবজ্ঞা আর ঘৃণার প্রতীক।
১৯৭১ সালের আগে যখনই আমি বাঙালিদের ওপর আরোপিত বৈষম্য নিয়ে ভাবতাম, পাকিস্তানকে আমার দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার মতো মনে হতো, যেখানে সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের কাছে নিগৃহীত ও ভৃত্যরূপে বিবেচিত। পাঞ্জাবি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, ‘বন্ধ কর রাজ পাক্কে নেহি হোতে।’ এর মানে হলো, ‘স্বৈরশাসন কখনোই স্থায়ী হয় না।’ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—মাত্র ২৪ বছর এই স্বৈরাচারী রাজত্ব টিকে ছিল। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি এ শ্রেণিবৈষম্য থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানসহ পৃথিবীর কত দেশের শত শত মানুষ এখনো শ্রেণিবৈষম্যের এই বন্দিত্ব ভোগ করতে বাধ্য হচ্ছে।
আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ নিজের অতীত থেকে শিক্ষা নেবে এবং শ্রেণিবৈষম্য থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি সব জায়গায় সব রকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। এ যুদ্ধে তাদের অবশ্যই লড়াই করতে হবে। এটা তো তাদের আবশ্যকীয় কর্তব্য ও দায়িত্বও বটে।
৩. বৈরিতা ও প্রতিশোধ
১৯৭১ সালে আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল নিয়মতন্ত্রের রোষানলে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে এসে আমার হৃদয়ে বাঙালিদের জন্য ভালোবাসার দীপশিখা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন তারা আমার সহোদর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বিজয়ের ফলে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ায় তাদের মনে হতে লাগল শৌর্য-বীর্যময় এক জাতি। তাদের সান্নিধ্য লাভের জন্য আমি উতলা হয়ে উঠলাম। কিন্তু সত্য যে কঠিন। কোনো বাঙালির সঙ্গে দেখা হলে ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে সরে যেত, যেন আমি ভয়ানক হিংস্র কোনো প্রাণী।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানে থেকে যাওয়া বাঙালিরা দুটি শ্রেণিতে ভাগ হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধে যারা পাকিস্তানিদের দোসরের ভূমিকা পালন করেছে, তারা একটি অংশ। পাকিস্তানকে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ বাসভূমি আর বাংলাদেশকে শত্রুরাষ্ট্র মনে করত। অন্য অংশে ছিল সেই শ্রেণিটি, যারা এখানে চাকরি করতে বা অন্য কোনো কারণে এসে যুদ্ধের সময়ে আটকা পড়েছে। এদের মধ্যে অনেকে চুপিসারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছে। এদের কেউ উগ্র পাকিস্তানি বা ইসলামের তকমাধারী দুর্বৃত্তের হিংস্র থাবায় ফেঁসে গেলে নিজেদের বাঁচাতে বাংলাদেশ, মুক্তিবাহিনী, ভারত এবং বড় বড় বাঙালি নেতার সমালোচনা করত। কিন্তু অবস্থা বুঝে আবার উল্টো ভূমিকা পালন করতে তারা সদা সতর্ক ও প্রস্তুত থাকত। স্বভাবতই আত্মপরিচয় গোপন রাখতে তারা তৎপর ছিল।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হার মানার কথা মোটেও ভাবেনি। সেই ধারাতেই তারা সব চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। এ জন্য তারা নানা কিছু করত। যেমন ১. ১৯৬৫ সালের মতো এ যুদ্ধেও আমাদেরই জয় হবে—এই বিশ্বাসে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পাকিস্তানি সৈন্যদের লড়াই ও কথিত বীরত্বগাথা তথ্যমাধ্যমে চটকদার করে প্রকাশ করা হতো।
২. অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত এবং তাদের ইসলামি উগ্রবাদী সহযোগীদের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অসহায় সাজিয়ে বহির্বিশ্বের সহানুভূতি পেতে চাইত। পাকিস্তানি সৈন্য, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, পিপলস পার্টি, বন্ধুরাষ্ট্র চীনের সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলসহ সব কটি ইসলামি দল এই চলচ্চিত্রটিতে প্রধান কুশীলবের ভূমিকা পালন করত।
পাকিস্তানি তথ্যমাধ্যম ভারতীয় জেলে বন্দী পাশবিক সৈন্যদের সব সময় অসহায় ও নির্যাতিত হিসেবে উপস্থাপন করত। ১৯৭৩ সালের একটি ঘটনা আমার মনে আছে। আমি পাকিস্তান টিভিতে প্রযোজকের দায়িত্ব পালন করার সময় পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতে কারাবন্দী ছিল। প্রতিটি টিভি চ্যানেলে তখন এই আদেশ জারি করা হয়েছিল যে, এই জঙ্গি কয়েদিদের মধ্য থেকে যারা এখনো ছাড়া পায়নি, তাদের নির্যাতিত হিসেবে তুলে ধরতে হবে। এমনকি মানবতাবাদী কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজও এই যুদ্ধবন্দীদের নিপীড়িত হিসেবে বর্ণনা করে গান লিখেছেন।
এসব চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে তারা ‘কোরবানির পশু’র সন্ধানেও থাকত। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব পাকিস্তানি নাগরিক সহায়তা করেছে, তাদের এ ক্ষেত্রে কোরবানির পশু ব্যবহার করা হতো। তাদের সব সময় জাতির শত্রু, গাদ্দার ও হিন্দুস্তানের অ্যাজেন্ট অভিধা মাথায় পেতে নিয়ে কটাক্ষের শিকার হতে হতো। যেসব অভিজাত ও উচ্চপদস্থ বাঙালিরা সে সময়ে কোনো কারণে পাকিস্তানে আটকে গেছেন, তাঁরাও এই কটাক্ষের পাত্র হতেন। তাঁদের অবস্থা ছিল হিটলারের জার্মানিতে নাৎসিদের হাতে বন্দী ইহুদিদের মতো। ভয়ার্ত জীবনযাপন করার কারণে তাঁরা কখনো কারও ওপর বিশ্বাস রাখতে পারতেন না। সব সময়ই তাঁরা প্রাণপণে চেষ্টা করতেন, যাতে কোনোভাবে পাকিস্তান সীমান্ত পার হয়ে যাওয়া যায়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার অপরাধে প্রাপ্ত গাদ্দার খেতাব পাওয়ায় এবং সে কারণে তাতে ঘৃণিত হওয়ায় আমি নিজেকে বাঙালিদের বন্ধু, সহযোগী ও সহমর্মী ভাবতাম। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! পাকিস্তানে থাকা এই বাঙালিরা আমাকে সাহচর্য দেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো পাকিস্তানি নাগরিক বলে তারা আমাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখত।
১৯৭৭ সালে সুইডেনে চলে আসার পরপর আমি ভাবতাম, প্রবাসী বাঙালিরা নিশ্চয়ই পাকিস্তানে থাকা বাঙালিদের চেয়ে আলাদা হবে। আমি তাদের ভালো লাগা ও ভালোবাসার মানুষ হব। কিন্তু দুর্ভাগা আমার ঝামেলা শেষ হলো না। আমি পাকিস্তানি নাগরিক হওয়ায় পাকিস্তানে বসবাসরত বাঙালিরা আমাকে ভয় পেত। আর আমি পাকিস্তানি বলে সুইডেন-প্রবাসী বাঙালিরা আমাকে ঘৃণা করত। ইউরোপজুড়েই এ অবস্থা। আমি পাকিস্তানি বলে লন্ডনের একটি বাঙালি রেস্তোরাঁ থেকে আমাকে লাঞ্ছিত করে বের করে দেওয়া হয়।
বছরের পর বছর বাঙালিদের এ কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, আমি কাজ করেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, আর সে কারণে আমাকে কারাবরণও করতে হয়েছে। কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করেনি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার অপরাধে ১৯৭১ সালের সূচনায় কারাবরণ করে, দুর্বৃত্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এবং সারা জীবন পাকিস্তানিদের কাছে জাতির শত্রু ও গাদ্দার আখ্যা পেয়ে যে ব্যথা আমার বুকে লেগেছে, তার চেয়ে বেশি কষ্টকর ছিল বাঙালিদের বৈরিতা সহ্য করা। কারণ, তাদের সমর্থন করার জন্যই আমাকে কারাভোগ করতে হয়েছে, গাদ্দার পরিচয়ে সারা জীবন কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছে।
এভাবে যে আমি কত বৈরী আচরণ সহ্য করেছি, তার একমাত্র সাক্ষী আমার অন্তর আর অন্তর্যামী। এমন আচরণের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি আমার চলে গিয়েছিল বলে আমি বাঙালিদের কাছ থেকে দূরে দূরে সরে থাকতে শুরু করলাম। আর ঠিক তখনই দৈবক্রমে এমন একটি ঘটনা ঘটল, যা আমার পুরো জীবনটাই বদলে দিল। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের পৃথক হওয়ার কারণ বের করার জন্য ভুট্টো সরকার হামদুর রহমান কমিশন গঠন করেছিল। কমিশনের রিপোর্টে যে তথ্য উঠে এল, তা দেখে ভুট্টো সরকার ভড়কে গেল। ২০০০ সালে এ রিপোর্ট ফাঁস হয়ে গেল। ভারতীয় একটি পত্রিকা এটি ধারাবাহিকভাবে ছাপাতে শুরু করল। ফলে ২০০২ সালে পাকিস্তান সরকার রিপোর্টটি প্রকাশ করতে বাধ্য হলো। তাতে বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানিদের অন্য একটি অবয়ব ধরা পড়ল।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সহায়তাকারী বলে দাবি করেন, এমন লোকের সংখ্যা এ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে ক্রমেই বাড়তে লাগল। মজার ব্যাপার হলো, তাদের অধিকাংশই সে সময়ে ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তাকারী এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী। আমি তখন প্রকৃত সহায়তাকারী ও ভণ্ডদের কথা উল্লেখ করে পাকিস্তানের একটি পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখি। আমার ইচ্ছা ছিল, যেন বাংলাদেশেও এ প্রবন্ধটি ছাপা হয়। বাংলাদেশে তখন ছিল আওয়ামী লীগ সরকার। আমি সুইডেনে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করি। মোহাম্মদ সাদিক নামের এক সজ্জন ব্যক্তি আমাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন। আমার কথার সত্যতার দলিল হিসেবে তাঁকে আমি ১৯৭১ সালের অনেক পুরোনো পত্রিকা দিলাম। তিনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন এবং আমাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন। জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো বাঙালির ভালোবাসা পেয়ে আন্দোলিত হয়ে উঠলাম। আমার উপলব্ধি হলো, আমি যেন একটি আতঙ্কময় দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছি, মুক্তি পেয়েছি একটি বড় ধরনের আজাব থেকে। বৈরিতা ও ভালোবাসা—বাঙালি জাতির এ দুটি রূপই আমার দৃষ্টিগোচর হলো। বাঙালি বিশাল হৃদয়ের অধিকারী, কিন্তু তাদের বৈরী মনোভাবও আমাকে ভাবিয়ে তুলল।
বৈরিতা কী? আমার দৃষ্টিতে সেটি একটি মন্দ শক্তি। শত্রুর পাশাপাশি তা নিজেকেও দংশন করে। প্রতিপক্ষের মৃত্যুর প্রত্যাশায় তার বিষ সে নিজেও পান করে। পৃথিবীর ইতিহাসে হিংসা মানুষকে শুধু কষ্টই দিয়েছে। হিংসার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে কখনো কিছু সৃষ্টি তো হয়ইনি; বরং তা ডেকে এনেছে অনেক ধ্বংস। হিংসা থেকে জন্ম নেয় প্রতিশোধস্পৃহা, আর তা বাজিয়ে তোলে যুদ্ধের দামামা। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস, রক্তপাত আর হত্যাযজ্ঞ। এই হিংসার কারণেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে পৈশাচিকতা আর নাৎসি নারকীয়তাকে হার মানানো হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু বাঙালি কি সেখানেই থেকে যেতে চায়? অর্ধশতক আগে ঘটা সেই পাশবিকতা আর গণহত্যার কুশীলবদের বেশির ভাগই তো এখন মৃত। পাকিস্তানের শাসক ও সেনাবাহিনীকে সেই পৈশাচিকতা আর নারকীয়তার দায় নিশ্চয়ই বহন করতে হবে, কিন্তু পাকিস্তানের সব নাগরিকই কি সেই অভিযোগে অভিযুক্ত? যদি তা না হয়, তাহলে নিরপরাধ পাকিস্তানিদের আর ঘৃণা, অবমাননা ও লাঞ্ছনার প্রয়োজন কী? প্রবাসী কর্মজীবীদেরই–বা হেয় করে কী লাভ? এতগুলো বছর কেন আমাকে বৈরিতা আর লাঞ্ছনা বহন করতে হলো? আমার তো কোনো দোষ ছিল না?
পাকিস্তানিদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইলে বাংলাদেশের এখন উচিত জাপানি কৌশল অবলম্বন করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু বোমায় অসংখ্য জাপানির হতাহতের পর জাপানিরা কিন্তু প্রতিহিংসার বশে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেনি। তারা বরং প্রতিশোধ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে শ্রমিক পর্যন্ত সবার ঘর জাপানি পণ্যে ভাসিয়ে দিয়ে। তাই বৈরিতা নয়, বরং বাংলাদেশের উচিত নিজের জাতিসত্তা, শিক্ষা, অর্থনীতি ও শিল্পোন্নতির উৎকর্ষ দিয়ে পাকিস্তানকে পরাস্ত করা।
উর্দু থেকে অনুবাদ: ফারহানা মিষ্টি।
১৯৭১ সালে আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল নিয়মতন্ত্রের রোষানলে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে এসে আমার হৃদয়ে বাঙালিদের জন্য ভালোবাসার দীপশিখা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন তারা আমার সহোদর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বিজয়ের ফলে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ায় তাদের মনে হতে লাগল শৌর্য-বীর্যময় এক জাতি। তাদের সান্নিধ্য লাভের জন্য আমি উতলা হয়ে উঠলাম। কিন্তু সত্য যে কঠিন। কোনো বাঙালির সঙ্গে দেখা হলে ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে সরে যেত, যেন আমি ভয়ানক হিংস্র কোনো প্রাণী।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানে থেকে যাওয়া বাঙালিরা দুটি শ্রেণিতে ভাগ হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধে যারা পাকিস্তানিদের দোসরের ভূমিকা পালন করেছে, তারা একটি অংশ। পাকিস্তানকে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ বাসভূমি আর বাংলাদেশকে শত্রুরাষ্ট্র মনে করত। অন্য অংশে ছিল সেই শ্রেণিটি, যারা এখানে চাকরি করতে বা অন্য কোনো কারণে এসে যুদ্ধের সময়ে আটকা পড়েছে। এদের মধ্যে অনেকে চুপিসারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছে। এদের কেউ উগ্র পাকিস্তানি বা ইসলামের তকমাধারী দুর্বৃত্তের হিংস্র থাবায় ফেঁসে গেলে নিজেদের বাঁচাতে বাংলাদেশ, মুক্তিবাহিনী, ভারত এবং বড় বড় বাঙালি নেতার সমালোচনা করত। কিন্তু অবস্থা বুঝে আবার উল্টো ভূমিকা পালন করতে তারা সদা সতর্ক ও প্রস্তুত থাকত। স্বভাবতই আত্মপরিচয় গোপন রাখতে তারা তৎপর ছিল।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হার মানার কথা মোটেও ভাবেনি। সেই ধারাতেই তারা সব চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। এ জন্য তারা নানা কিছু করত। যেমন ১. ১৯৬৫ সালের মতো এ যুদ্ধেও আমাদেরই জয় হবে—এই বিশ্বাসে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পাকিস্তানি সৈন্যদের লড়াই ও কথিত বীরত্বগাথা তথ্যমাধ্যমে চটকদার করে প্রকাশ করা হতো।
২. অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত এবং তাদের ইসলামি উগ্রবাদী সহযোগীদের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অসহায় সাজিয়ে বহির্বিশ্বের সহানুভূতি পেতে চাইত। পাকিস্তানি সৈন্য, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, পিপলস পার্টি, বন্ধুরাষ্ট্র চীনের সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলসহ সব কটি ইসলামি দল এই চলচ্চিত্রটিতে প্রধান কুশীলবের ভূমিকা পালন করত।
পাকিস্তানি তথ্যমাধ্যম ভারতীয় জেলে বন্দী পাশবিক সৈন্যদের সব সময় অসহায় ও নির্যাতিত হিসেবে উপস্থাপন করত। ১৯৭৩ সালের একটি ঘটনা আমার মনে আছে। আমি পাকিস্তান টিভিতে প্রযোজকের দায়িত্ব পালন করার সময় পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতে কারাবন্দী ছিল। প্রতিটি টিভি চ্যানেলে তখন এই আদেশ জারি করা হয়েছিল যে, এই জঙ্গি কয়েদিদের মধ্য থেকে যারা এখনো ছাড়া পায়নি, তাদের নির্যাতিত হিসেবে তুলে ধরতে হবে। এমনকি মানবতাবাদী কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজও এই যুদ্ধবন্দীদের নিপীড়িত হিসেবে বর্ণনা করে গান লিখেছেন।
এসব চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে তারা ‘কোরবানির পশু’র সন্ধানেও থাকত। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব পাকিস্তানি নাগরিক সহায়তা করেছে, তাদের এ ক্ষেত্রে কোরবানির পশু ব্যবহার করা হতো। তাদের সব সময় জাতির শত্রু, গাদ্দার ও হিন্দুস্তানের অ্যাজেন্ট অভিধা মাথায় পেতে নিয়ে কটাক্ষের শিকার হতে হতো। যেসব অভিজাত ও উচ্চপদস্থ বাঙালিরা সে সময়ে কোনো কারণে পাকিস্তানে আটকে গেছেন, তাঁরাও এই কটাক্ষের পাত্র হতেন। তাঁদের অবস্থা ছিল হিটলারের জার্মানিতে নাৎসিদের হাতে বন্দী ইহুদিদের মতো। ভয়ার্ত জীবনযাপন করার কারণে তাঁরা কখনো কারও ওপর বিশ্বাস রাখতে পারতেন না। সব সময়ই তাঁরা প্রাণপণে চেষ্টা করতেন, যাতে কোনোভাবে পাকিস্তান সীমান্ত পার হয়ে যাওয়া যায়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার অপরাধে প্রাপ্ত গাদ্দার খেতাব পাওয়ায় এবং সে কারণে তাতে ঘৃণিত হওয়ায় আমি নিজেকে বাঙালিদের বন্ধু, সহযোগী ও সহমর্মী ভাবতাম। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! পাকিস্তানে থাকা এই বাঙালিরা আমাকে সাহচর্য দেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো পাকিস্তানি নাগরিক বলে তারা আমাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখত।
১৯৭৭ সালে সুইডেনে চলে আসার পরপর আমি ভাবতাম, প্রবাসী বাঙালিরা নিশ্চয়ই পাকিস্তানে থাকা বাঙালিদের চেয়ে আলাদা হবে। আমি তাদের ভালো লাগা ও ভালোবাসার মানুষ হব। কিন্তু দুর্ভাগা আমার ঝামেলা শেষ হলো না। আমি পাকিস্তানি নাগরিক হওয়ায় পাকিস্তানে বসবাসরত বাঙালিরা আমাকে ভয় পেত। আর আমি পাকিস্তানি বলে সুইডেন-প্রবাসী বাঙালিরা আমাকে ঘৃণা করত। ইউরোপজুড়েই এ অবস্থা। আমি পাকিস্তানি বলে লন্ডনের একটি বাঙালি রেস্তোরাঁ থেকে আমাকে লাঞ্ছিত করে বের করে দেওয়া হয়।
বছরের পর বছর বাঙালিদের এ কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, আমি কাজ করেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, আর সে কারণে আমাকে কারাবরণও করতে হয়েছে। কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করেনি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার অপরাধে ১৯৭১ সালের সূচনায় কারাবরণ করে, দুর্বৃত্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এবং সারা জীবন পাকিস্তানিদের কাছে জাতির শত্রু ও গাদ্দার আখ্যা পেয়ে যে ব্যথা আমার বুকে লেগেছে, তার চেয়ে বেশি কষ্টকর ছিল বাঙালিদের বৈরিতা সহ্য করা। কারণ, তাদের সমর্থন করার জন্যই আমাকে কারাভোগ করতে হয়েছে, গাদ্দার পরিচয়ে সারা জীবন কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছে।
এভাবে যে আমি কত বৈরী আচরণ সহ্য করেছি, তার একমাত্র সাক্ষী আমার অন্তর আর অন্তর্যামী। এমন আচরণের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি আমার চলে গিয়েছিল বলে আমি বাঙালিদের কাছ থেকে দূরে দূরে সরে থাকতে শুরু করলাম। আর ঠিক তখনই দৈবক্রমে এমন একটি ঘটনা ঘটল, যা আমার পুরো জীবনটাই বদলে দিল। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের পৃথক হওয়ার কারণ বের করার জন্য ভুট্টো সরকার হামদুর রহমান কমিশন গঠন করেছিল। কমিশনের রিপোর্টে যে তথ্য উঠে এল, তা দেখে ভুট্টো সরকার ভড়কে গেল। ২০০০ সালে এ রিপোর্ট ফাঁস হয়ে গেল। ভারতীয় একটি পত্রিকা এটি ধারাবাহিকভাবে ছাপাতে শুরু করল। ফলে ২০০২ সালে পাকিস্তান সরকার রিপোর্টটি প্রকাশ করতে বাধ্য হলো। তাতে বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানিদের অন্য একটি অবয়ব ধরা পড়ল।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সহায়তাকারী বলে দাবি করেন, এমন লোকের সংখ্যা এ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে ক্রমেই বাড়তে লাগল। মজার ব্যাপার হলো, তাদের অধিকাংশই সে সময়ে ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তাকারী এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী। আমি তখন প্রকৃত সহায়তাকারী ও ভণ্ডদের কথা উল্লেখ করে পাকিস্তানের একটি পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখি। আমার ইচ্ছা ছিল, যেন বাংলাদেশেও এ প্রবন্ধটি ছাপা হয়। বাংলাদেশে তখন ছিল আওয়ামী লীগ সরকার। আমি সুইডেনে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করি। মোহাম্মদ সাদিক নামের এক সজ্জন ব্যক্তি আমাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন। আমার কথার সত্যতার দলিল হিসেবে তাঁকে আমি ১৯৭১ সালের অনেক পুরোনো পত্রিকা দিলাম। তিনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন এবং আমাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন। জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো বাঙালির ভালোবাসা পেয়ে আন্দোলিত হয়ে উঠলাম। আমার উপলব্ধি হলো, আমি যেন একটি আতঙ্কময় দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছি, মুক্তি পেয়েছি একটি বড় ধরনের আজাব থেকে। বৈরিতা ও ভালোবাসা—বাঙালি জাতির এ দুটি রূপই আমার দৃষ্টিগোচর হলো। বাঙালি বিশাল হৃদয়ের অধিকারী, কিন্তু তাদের বৈরী মনোভাবও আমাকে ভাবিয়ে তুলল।
বৈরিতা কী? আমার দৃষ্টিতে সেটি একটি মন্দ শক্তি। শত্রুর পাশাপাশি তা নিজেকেও দংশন করে। প্রতিপক্ষের মৃত্যুর প্রত্যাশায় তার বিষ সে নিজেও পান করে। পৃথিবীর ইতিহাসে হিংসা মানুষকে শুধু কষ্টই দিয়েছে। হিংসার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে কখনো কিছু সৃষ্টি তো হয়ইনি; বরং তা ডেকে এনেছে অনেক ধ্বংস। হিংসা থেকে জন্ম নেয় প্রতিশোধস্পৃহা, আর তা বাজিয়ে তোলে যুদ্ধের দামামা। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস, রক্তপাত আর হত্যাযজ্ঞ। এই হিংসার কারণেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে পৈশাচিকতা আর নাৎসি নারকীয়তাকে হার মানানো হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু বাঙালি কি সেখানেই থেকে যেতে চায়? অর্ধশতক আগে ঘটা সেই পাশবিকতা আর গণহত্যার কুশীলবদের বেশির ভাগই তো এখন মৃত। পাকিস্তানের শাসক ও সেনাবাহিনীকে সেই পৈশাচিকতা আর নারকীয়তার দায় নিশ্চয়ই বহন করতে হবে, কিন্তু পাকিস্তানের সব নাগরিকই কি সেই অভিযোগে অভিযুক্ত? যদি তা না হয়, তাহলে নিরপরাধ পাকিস্তানিদের আর ঘৃণা, অবমাননা ও লাঞ্ছনার প্রয়োজন কী? প্রবাসী কর্মজীবীদেরই–বা হেয় করে কী লাভ? এতগুলো বছর কেন আমাকে বৈরিতা আর লাঞ্ছনা বহন করতে হলো? আমার তো কোনো দোষ ছিল না?
পাকিস্তানিদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইলে বাংলাদেশের এখন উচিত জাপানি কৌশল অবলম্বন করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু বোমায় অসংখ্য জাপানির হতাহতের পর জাপানিরা কিন্তু প্রতিহিংসার বশে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেনি। তারা বরং প্রতিশোধ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে শ্রমিক পর্যন্ত সবার ঘর জাপানি পণ্যে ভাসিয়ে দিয়ে। তাই বৈরিতা নয়, বরং বাংলাদেশের উচিত নিজের জাতিসত্তা, শিক্ষা, অর্থনীতি ও শিল্পোন্নতির উৎকর্ষ দিয়ে পাকিস্তানকে পরাস্ত করা।
উর্দু থেকে অনুবাদ: ফারহানা মিষ্টি।
No comments:
Post a Comment